শীতকালীন ঠাণ্ডা পানি ও আবহাওয়া অজু-গোসলকে কখনো কষ্টকর করে তোলে। কিন্তু ইসলামি শরিয়ত পবিত্রতার মৌলিক বিধানগুলোর পাশাপাশি এ সময়ের জন্য বিশেষ কিছু সহায়ক নিয়মও দিয়েছে। নিম্নে শীতকালীন অজু-গোসলের পাঁচটি অপরিহার্য মাসয়ালা ও এর দলিলসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. অজুর অঙ্গ পূর্ণভাবে ধৌত করা ফরজ
শীতকালে ঠাণ্ডার কারণে অনেকেই দ্রুত অজু করে থাকেন, কিন্তু ইসলামি শরিয়তের মৌলিক বিধান হলো অজুর ফরজ অঙ্গসমূহ—মুখমণ্ডল, উভয় হাত কনুইসহ, মাথা মাসেহ ও উভয় পা টাখনুসহ—পূর্ণভাবে পানি দ্বারা ধৌত করা। হাদিসে স্পষ্ট সতর্কতা রয়েছে- আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন- কোনো এক সফরে আল্লাহর রাসুল (স.) আমাদের পেছনে পড়ে গেলেন। পরে তিনি আমাদের কাছে পৌঁছলেন। এদিকে আমরা (আছরের) নামাজ আদায় করতে বিলম্ব করে ফেলেছিলাম। তাই (তা আদায় করার জন্য) আমরা অজু করা শুরু করলাম। এ সময় আমরা আমাদের পা কোনোমতে পানি দ্বারা ভিজিয়ে নিচ্ছিলাম। তখন তিনি উচ্চ স্বরে বলেন, ‘সর্বনাশ! গোড়ালির নিম্নাংশগুলোর জন্য জাহান্নামের আগুন রয়েছে।’ তিনি দুই বা তিনবার এ কথা বললেন। (বুখারি: ৯৬, মুসলিম: ২৪১) তাই শীতকালেও প্রতিটি অঙ্গের সব অংশ ভালোভাবে ভেজাতে হবে; কোনো অংশ শুকনো থাকলে অজু শুদ্ধ হবে না।
২. তৈলাক্ত বা ক্রিমের স্তর পানি পৌঁছাতে বাধা দেয় কি না যাচাই করা
শীতকালে ত্বক রক্ষার্থে নানা ধরনের তেল, ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা হয়। ইসলামি ফিকহের নিয়ম হলো, কোনো বস্তু যদি ত্বকের ওপর এমন স্তর তৈরি করে যার নিচে পানি প্রবেশ করতে পারে না, তাহলে তা দূর না করে অজু বা গোসল শুদ্ধ হবে না। আল্লামা ইবনে উসাইমিন (রহ.) তার ‘ফতোয়াতুত তাহারাহ’-তে উল্লেখ করেছেন, জমাটবদ্ধ তেল, মলম বা মোম জাতীয় পদার্থ যা ত্বকের রন্ধ্র বন্ধ করে দেয়, তা অপসারণ করা অপরিহার্য (পৃষ্ঠা: ১৭৪)। তবে সাধারণ তেল (যেমন: অলিভ অয়েল, সরিষার তেল) বা তরল লোশন যা ত্বকের মধ্যে শুষে নেওয়া যায় এবং পানি প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে না, সেগুলোর ক্ষেত্রে শুধু হাত বুলিয়ে নিশ্চিত করতে হবে যে পানি ত্বক স্পর্শ করেছে।
৩. প্রসাধনী ও রংয়ের স্তর সম্পর্কে সতর্কতা
নারীদের ক্ষেত্রে মেহেদি, সুরমা, সাধারণ পাউডার বা আতর সাধারণত অজু-গোসলের পথে বাধা নয়, কারণ এগুলো ত্বকের রন্ধ্রে প্রবেশ করে বা পাতলা স্তর তৈরি করে। ইমাম কাসানি (রহ.) ‘বাদায়েউস সানায়ে’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, যা ত্বকের সঙ্গে মিশে যায় এবং পানি পৌঁছাতে বাধা দেয় না, তা অপসারণ করা জরুরি নয়। তবে আধুনিক কেমিক্যালযুক্ত নেইলপলিশ, লিপস্টিক, কৃত্রিম মেহেদি (যা ত্বকে আস্তরণ তৈরি করে) বা জেল জাতীয় প্রসাধনী অবশ্যই অপসারণ করতে হবে, কারণ এগুলো পানি পৌঁছাতে বাধা দেয়। ফিকহি নিয়ম হলো: চামড়ায় পানি পৌঁছানো ফরজ, যেকোনো বস্তু তা প্রতিরোধ করলে তা দূর করা আবশ্যক।
৪. মাসেহ (মোজা মোছা) ও তায়াম্মুমের শরয়ি সুযোগ
শীতকালে শরিয়ত প্রদত্ত কিছু ছাড় ও সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, পবিত্রতা অর্জনের পর মোটা ও পুরু উল/পশমের মোজা বা চামড়ার মোজা পরিধান করলে, পরবর্তী ২৪ ঘন্টা (মুকিমের জন্য) বা ৭২ ঘন্টা (মুসাফিরের জন্য) শুধু মোজার উপর তিন আঙুল দিয়ে মাসেহ করলেই পা ধৌত হয়েছে বলে গণ্য হবে। হাদিসে বর্ণিত: ‘মুসাফির তিন দিন তিন রাত, আর মুকিম এক দিন এক রাত পর্যন্ত মোজা মোছে নিতে পারবে।’ (তিরমিজি: ৯৯)। দ্বিতীয়ত, যদি ঠাণ্ডা পানিতে অজু করলে রোগ বৃদ্ধি বা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা থাকে, অথবা পানি গরম করার কোনো ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে তায়াম্মুম করার অনুমতি রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যদি পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর।’ (সুরা মায়িদা: ৬)। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, তায়াম্মুম শুধু অজু বা গোসলের বিকল্প, নামাজের সময় সীমার মধ্যে পানি পাওয়া গেলে তা দিয়েই পবিত্রতা অর্জন করে নিতে হবে।
৫. গোসলের ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন
শীতকালে গোসলের সময় পুরো দেহে পানি পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘ চুল বা ঘন দাড়ির নিচে পানি পৌঁছানো আবশ্যক। যদি চুল বা দাড়ি জটবদ্ধ হয়, তাহলে জট খুলে বা হাত দিয়ে চুল আলগা করে নিশ্চিত করতে হবে যে পানি ত্বকে পৌঁছেছে। ইমাম নববি (রহ.) ‘আল-মাজমু’ গ্রন্থে বলেছেন, চুলের জটের ভেতরে পানি পৌঁছানো ফরজ নয়, যদি তা সাধারণভাবে খোলা না যায়; তবে বাহ্যিক অংশে পানি দিতে হবে। গোসলের সময় দ্রুততা না এনে ধীরে ধীরে ও পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ফরজ অংশগুলো আদায় করতে হবে। ঠাণ্ডা এড়ানোর জন্য উষ্ণ পানি ব্যবহার করা জায়েজ, তবে পানি গরম করার সামর্থ্য না থাকলে বা স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলে সংক্ষিপ্ত কিন্তু পূর্ণ গোসল আদায় করতে হবে।
শীতকালে অজু-গোসলের ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের বিধানগুলো যথাযথভাবে পালন করা ঈমানি দায়িত্ব। অজুর অঙ্গ পূর্ণভাবে ধৌত করা, প্রসাধনী ও তেলের স্তর যাচাই করা, মাসেহ ও তায়াম্মুমের শরয়ি সুযোগ গ্রহণ এবং গোসলের সময় পানি পূর্ণভাবে পৌঁছানো নিশ্চিত করলে পবিত্রতা শুদ্ধ হবে। নামাজসহ সকল ইবাদতের ভিত্তি হলো পবিত্রতা, তাই শীতের অসুবিধাকে অজুহাত না করে শরিয়তের সুযোগ ও শর্ত মেনে পবিত্রতা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য।
ডেস্ক/ই.ই
মন্তব্য করুন: