[email protected] ঢাকা | শুক্রবার, ১৪ই মার্চ ২০২৫, ৩০শে ফাল্গুন ১৪৩১
thecitybank.com

নারীকে যে মর্যাদা দিয়েছে ইসলাম

চাঁপাই জার্নাল ডেস্ক:

প্রকাশিত:
৯ মার্চ ২০২৫, ১৯:১০

ছবি: সংগ্রহীত

নারীর মাধ্যমেই পৃথিবীতে পুরুষের আগমন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন পুরুষের সঙ্গে জরিয়ে আছেন নারী। জন্মাদাত্রী মা, মমতাময়ী বোন, জীবনসঙ্গী — সব ক্ষেত্রেই নারীর উপস্থিতি। 

নারী-পুরুষ একে অপরের নির্ভরতা বা ছায়া হয়ে থাকার এই চল সৃষ্টির সূচনা থেকেই। আল্লাহ তায়ালা আদম আ.-কে সৃষ্টির পর তার সঙ্গী হিসেবে সৃষ্টি করলেন আদিমাতা হওয়া আ.-কে। তারা একসঙ্গে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে এলেন। মানব জাতির বিস্তার ঘটলো তাদের মাধ্যমে।

পৃথিবীতে আদি পিতা, আদি মাতা অথবা বলা যেতে পারে নারী ও পুরুষের আগমন হয়েছিল একসঙ্গে। একজন ছিলেন মানব-জাতির পিতা, অন্যজন মাতা। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রথম শিশুটি নারীকে পেয়েছিল মমতাময়ী মায়ের রূপে। পুরুষকে পেয়েছে বাবা হিসেবে।

পথ-পরিক্রমা পেরিয়ে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। নারী-পুরুষের মাঝে তারতম্য, পার্থক্য দেখা দিয়েছে দিনে দিনে। অনেক ক্ষেত্রে নারী অবহেলিত হয়েছেন। বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। 

নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে মহানবী সা.-এর অবস্থান

ইতিহাস বলে এক সময় নারীকে উটকো ঝামেলা মনে করা হতো। অনেকে ভাবতেন ভোগের সামগ্রী। ইতিহাসে নারীকে জীবন্ত পুতে ফেলার ঘটনাও সংরক্ষিত রয়েছে। নারীর জীবনের এমন কঠিন মুহূর্তে ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা. আগমন করেছিলেন। নারীর প্রতি বর্বরতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তিনি। মা, স্ত্রী, কন্যা সন্তান যেই রূপেই পুরুষের জীবনে নারীর আগমন ঘটুক তার সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছেন তিনি। এর বাইরে যেকোনো নারীকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার শিক্ষাও দিয়েছেন তিনি। কখনো কোনো নারীর প্রতি কুদৃষ্টিতে তাকাতে নিষেধ করেছেন। নারীর প্রতি কুদৃষ্টিকে গুনাহ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

মা হিসেবে নারীর মর্যাদা

মা-বাবা দুজনের মাধ্যমেই নবজাতকের জন্ম হয়। শিশুর জীবনের দুজনই সমান গুরুত্ব বহন করে। তবে ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা. সন্তানের জন্য মায়ের সম্মান ও মর্যাদাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, বাবার থেকে মায়ের অধিকার বেশি বলেছেন তিনি। 

এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে-হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবি করিম (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জানতে চান, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মধ্যে আমার কাছে সর্বোত্তম সেবা লাভের অধিকার কার?’ নবি করিম (সা.) বলেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি আবার জানতে চান, ‘তারপর কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি আবার জানতে চান, ‘তারপর কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি আবারও জানতে চান, ‘তারপর কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার পিতার।’ (বুখারি ও মুসলিম)।স্ত্রী হিসেবে নারীর মর্যাদা

পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়মের অংশ হিসেবে নারী-পুরুষের জীবনসঙ্গী হন। বৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে তারা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে আবদ্ধ হন। সামাজিক জীবনে দুজনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া নারীকে আগলে রাখার দায়িত্ব পুরুষের ওপর অর্পণ করা হয়েছে ইসলামে। স্বামীকে স্ত্রীর সঙ্গে ভালো আচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

আল কোরআনে বলা হয়েছে, 'আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে বসবাস করো সদাচারের সঙ্গে। আর যদি তোমরা কোনো কারণে তাদের অপছন্দ করো, তাহলে হয়তো তোমরা এমন একটি বস্তুকে অপছন্দ করলে, যাতে আল্লাহ তায়ালা প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন। (সূরা নিসা, আয়াত : ১৯)।

রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। (তিরমিজি, হাদিস : ১১৬৩)।

একজন পুরুষ ব্যক্তি জীবনে কতটা ভালো বা মন্দ ইসলামে তা নির্ধারণের মাপকাঠি করা হয়েছে স্ত্রীকে। স্ত্রীর সঙ্গে মানুষ নিজের একান্ত মুহূর্তগুলো কাটান। তাই যে ব্যক্তিকে তার স্ত্রী ভালো মনে করে তাকেই সর্বোত্তম বলে গণ্য করা হয়েছে হাদিসে।

 হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, মুমিনদের মধ্যে পরিপূর্ণ মুমিন ওই ব্যক্তি, যার ব্যবহার ও চরিত্র সর্বাপেক্ষা উত্তম। আর তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যে স্ত্রীদের কাছে উত্তম। (তিরমিজি)

কন্যা সন্তান হিসেবে নারীর মর্যাদা

কন্যা সন্তানকে শান্তির প্রতীক মনে করা হয়। আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর কোনো ছেলে সন্তান ছিল না। মেয়েদের মাধ্যমেই তাঁর বংশ পরম্পরা টিকে রয়েছে।

কারো প্রথম কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণকে হাদিসে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ উমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন—

ওই নারী বরকতময়ী ও সৌভাগ্যবান, যার প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। কেননা, (সন্তানদানের নেয়ামত বর্ণনা করার ক্ষেত্রে) আল্লাহ তায়ালা মেয়েকে আগে উল্লেখ করে বলেন, তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। ’ (কানযুল উম্মাল ১৬:৬১১)

মেয়ে সন্তানকে আদর-যত্নে লালন-পালনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে হাদিসে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলনে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করনে—

যার ঘরে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলো, অতঃপর সে ওই কন্যাকে কষ্ট দেয়নি, মেয়ের ওপর অসন্তুষ্টও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে তার ওপর প্রধান্য দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ২২৩)

অপর হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন—

যার তিনটি কন্যাসন্তান থাকবে এবং সে তাদের কষ্ট-যাতনায় ধৈর্য ধরবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুহাম্মদ ইবন ইউনূসের বর্ণনায় এ হাদীসে অতিরিক্ত অংশ হিসেবে এসেছে) একব্যক্তি প্রশ্ন করলো, হে আল্লাহর রাসুল, যদি দু’জন হয়? উত্তরে তিনি বললেন, দু’জন হলেও। লোকটি আবার প্রশ্ন করলো, যদি একজন হয় হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বললেন, একজন হলেও। ’ (বাইহাকি, শুয়াবুল ঈমান : ৮৩১১)

প্রতিবেশী ও অন্যান্য নারীর মর্যাদা

মা, স্ত্রী, কন্যা, বোন— একজন পুরুষের জীবনের একান্ত আপনজন।ইসলামের দৃষ্টিতে এই নারীদের মাহরাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । তাদের মযার্দা, নিরাপত্তা ও দেখভালের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

আপনজন ছাড়াও প্রতিবেশী, সহকর্মী এবং বিভিন্নভাবে পুরুষের জীবনে নারীর উপস্থিতি রয়েছে। এই নারীদেরও সম্মান নিশ্চিত করার নির্দেশ রয়েছে ইসলামে। তাদের প্রতি কখনো কুদৃষ্টি দিতে নিষেধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে—

হে রাসুল!) ঈমানদার পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য অধিক পবিত্র।' (সূরা নুর : আয়াত ৩০)

দৃষ্টি সংযত রেখে নারীর সঙ্গে চলাফেরা করলে তার প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হবে না এবং যথাযথ মর্যাদা বজায় থাকবে। কুদৃষ্টি থেকেই মনের ভেতরে ভিন্ন ধারণা তৈরি হয় এবং সমাজের অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলো সৃষ্টি হয়। এ ধরণের ঘটনা এড়াতে রাসূল সা. বলেন—

মহান আল্লাহ অভিশম্পাত দেন কুদৃষ্টি দানকারী পুরুষ ও দৃষ্টিদানে সুযোগদানকারী নারীর ওপরও। (মিশকাত, হাদিস : ২৭০)

রাস্তা-ঘাটে হাট-বাজারে অনেক সময় অনাকাঙ্খিতভাবে পরনারী সামনে চলে আসে। ফলে হঠাৎ তার প্রতি অনাকাঙ্খিত দৃষ্টি পড়ে যায়। এমন দৃষ্টিকে রাসূল সা. ক্ষমাযোগ্য বলে ঘোষণা করেছেন। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে হজরত আলী রা. রাসূল সা.-কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে রাসূল সা. বলেন- 

হে আলী, অনাকাঙ্খিত দৃষ্টি পড়ে গেলে পুনরায় তুমি দৃষ্টি দিও না। কেননা প্রথম দৃষ্টি তোমর জন্য ক্ষমাযোগ্য কিন্ত পুনরায় দৃষ্টিপাত করা তোমার জন্য ক্ষমাযোগ্য নয়। (তিরমিজি, হাদিস : ২৭৭৭)

আমাদের জীবনে নারীর উপস্থিতি

রাসূল সা.-এর হাদিস এবং কোরআনের বাণীগুলোতে নারীর মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করার প্রতি স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী পৃথিবীতে নারীকে মা হিসেবেই পেয়েছিল প্রথম জন্ম নেওয়া নবজাতক। মায়ের মাধ্যমেই মানব জাতির বিস্তার। পথ-পরিক্রমা ও সময়ের বিস্মৃতিতে মায়ের স্থান থেকে সরিয়ে নারীকে নিপীড়ন-ভোগের সামগ্রী হিসেবে পরিণত করা হয়েছিল।

ইসলামের নবী নারীর মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছেন। মুসলিম সমাজে নারীকে সম্মানের চোখেই দেখা হয়। আমাদের সমাজে এখনো একজন সন্তানের জীবনে মা-কেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মায়ের উপস্থিতিই সন্তানকে তৃপ্তি দেয়। স্ত্রীকে সম্মান, নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন প্রত্যেক পুরুষ। কন্যা সন্তানকে শান্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে আদর-যত্নে লালন-পালন করেন বাবারা। অন্য নারীকেও সম্মানের চোখে দেখেন একজন পুরুষ। তাই তো কখনো কোনো নারীর প্রতি নিপীড়ন বা অসম্মানজনক আচরণ করা হলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন পুরুষেরা। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারা কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

সমাজে নারীর সঙ্গে ঘটা নিপীড়নমূলক ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন হিসেবে চিহ্নিত হোক এবং নারীর মর্যাদা নিশ্চিত হোক শতভাগ— এমন প্রত্যাশাই করি প্রতিনিয়ত।

ডেস্ক/আআ


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর