[email protected] ঢাকা | শনিবার, ১৫ই মার্চ ২০২৫, ৩০শে ফাল্গুন ১৪৩১
thecitybank.com

বরই চাষে সামিউল-নেফাউলের বাজিমাত, বছরে আয় ৩০ লাখ টাকা

নিজস্ব প্রতিনিধি:

প্রকাশিত:
১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১৭:৫২

বরই বাগানে পরিচর্যায় ব্যাস্ত চাষী সামিউল হক। ছবি: চাঁপাই জার্নাল

গম, ধান ও সরিষা অর্থাৎ দানা জাতীয় ফলস বেশি চাষ হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলায়। তবে ইউটিউবে ভিডিও দেখে ব্যাণিজিকভাবে বরই চাষে সফলতা অর্জন করেছেন সামিউল হক ও নেফাউল রহমান। তাদের ২৫ বিঘা বরই বাগানে প্রচুর পরিমানে বরই আসায় এ মৌসুমে তিনি কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকার বরই বিক্রির আশা করছেন। আর সব খরচ বাদ দিয়ে তাদের লাভ থাকবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা মতো।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের ডাংইপাড়া এলাকায় জমি লিজ নিয়ে এই বরই বাগান গড়ে তুলেছেন সামিউল ও নেফাউল। তারা সম্পর্কে আত্নীয়।

সরজমিনে বরই বাগানে গিয়ে জানা যায়, দীর্ঘ ৮ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরেন সামিউল হক। পরে তিনি দেশে ফিরে বেকার সময় কাটাতেন শুরু করেন। হঠাৎ ইউটিউবে বরই চাষের ভিডিও দেখে ব্যাণিজ্যিক ভাবে বরই বাগান করার চিন্তা করেন তিনি। পরে তার নিকট আত্নীয় নেফাউল রহমানের সাথে পরামর্শ করেন। নেফাউল রহমান আগে থেকেই কৃষি কাজ করতেন এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঁচামাল কিনে হাটে গিয়ে বিক্রি করতেন। তারা দুইজনে পরামর্শ করে প্রথমে ১৬ বিঘা মতো জমি লিজ নেয় । প্রথমদিকে বরই চাষ করে তেমন সফলতার মুখ না দেখলেও এই বছর আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় তাদের বাগানে ভালো ফলন এসেছে।

এছাড়া এই বরই বাগানে বল সুন্দরী, কাশ্মীরি, ভারত সুন্দরী, বেবি কুল, আগাম গুটি কুল, নারিকেল ও বাউ কুল জাতের বরই চাষ হচ্ছ। বাগানে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ জন শ্রমিক বাগান পরিচর্যাকারী হিসেবে কাজ করেন এবং তারা দৈনিক ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা বেতন পান।

গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে জানা যায়, আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। এই জেলার গোমস্তাপুর উপজেলায় আম চাষের পাশাপাশি মাল্টা, বরই, কমলাসহ অনান্য ফলসমূহও চাষ হয়ে থাকে। গত অর্থবছরে গোমস্তাপুর উপজেলায় বরই চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬০ হেক্টর জমিতে। যা এই অর্থবছরে ৫ হেক্টর বেড়ে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছে ১৬৫ হেক্টর জমিতে।

বরই বাগানের পরিচর্যা কর্মী রহমত আলী বলেন, আমি এই বাগানে বরই ভাংগি ও ক্যারেট করি। এছাড়া আরোও অনান্য কাজ করি যেমন, বরইয়ের গাছে পানি ও সার দেয়। আমরা এই বাগানে দুই বছর যাবত কাজ করি। আমরা এখানে ৪০০ টাকা বেতন পায়। যা দিয়ে আমাদের পরিবার চলে এবং আমাদের অনেক সুবিধা হয়। আমরা এখানে সকাল ৮ টার দিকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত কাজ করি। পরে খাবার বিরতি শেষে আবার দুপুর ১ থেকে  বিকেল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করি।

জাহিদ নামে আরেক বাগানের পরিচর্যা কর্মী বলেন, আমরা আগে বেকার ছিলাম। এখানে বরই চাষ করা দেখে আমরা কাজে এসেছি। সাড়ে ৪০০ টাকা বেতন পেয়ে আমরা অনেক খুশি। এতে ফ্যামিলি চালানোতে অনেক সুবিধা হয়। আশা করি ব্যাবসাটা অনেক এগিয়ে যাক এবং কাজ করে যেন আমরা সুবিধা পায়। এখানে আমরা মূলত, বরই ভাংগি, ক্যারেট করি এবং আবার ক্যারেট দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানোর কাজ করি।

বরই চাষী নেফাউল রহমান বলেন, রহনপুরে আমাদের বাগান করা প্রায় ৫ বছর হলো। এর আগে আমরা ব্যাবসা করতাম তবে এইভাবে ব্যাণিজ্যিকভাবে করিনি। ব্যাণিজ্যিক ভাবে প্রায় ৫ বছর থেকে বাগান করছি। অনান্য বছরের চেয়ে এইবছর বাজারজাত ভালো হওয়ার কারনে সবকিছু বাদ দিয়ে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা মতো আয় হবে। আমাদের এখানের বাগানের বরইগুলো অনেক সুস্বাদু। তাই বাংলাদেশের যেমন চিটাগাং, ঢাকাসহ অনান্য জায়গাতে বরই যাচ্ছে। বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এসে এখান থেকে বরই কিনে নিয়ে যায় এবং তারাও উপকৃত হচ্ছে।

বরই চাষী সামিউল হক বলেন, আমি দীর্ঘ ৮ বছর প্রবাসে থাকি এবং ২০১৯ সালে প্রবাস থেকে দেশে ফিরে আসি। দেশের আসার পর বেকার ছিলাম। হঠাৎ ইউটিউবে দেখতে পায় কুল (বরই) চাষ। তাই কুল চাষে আমার আগ্রহ হয় এবং আমি এক (নেফাউর রহমান) আত্নীয়ের সাথে পরামর্শ করি। পরে তাকে সাথে নিয়েই প্রথমে ১৬ বিঘা জমি লিজ নিই। আর এখন ৪০ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করছি। এছাড়া আমার বাগানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন মতো কাজ করে। তাদের কর্মসংস্থান করতে পেরে নিজেকে খুব ভালো লাগে। এই বছর প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা মতো বিক্রি করেছি। আরোও ৪০ লক্ষ টাকা পাবো বলে আশা করছি। আর সবকিছু বাদ দিয়ে ৩০ লক্ষ টাকা আয় হবে বলে আশা করছি।

তিনি আরোও বলেন, গত বছর আমাদের আয় কম হয়েছিল। সব মিলিয়ে ১৫ লক্ষ টাকা মতো টিকেছিল। এই বছর ৩০ লক্ষ টাকা মতো আয় হবে বলে আশা করছি। আমার এখানে ৪ বছর মতো হয়েছে বাগান করা। বিগত ৩ বছর আমি কৃষি অফিস থেকে কোন সহোযোগিতা পায়নি। এখানে তানভির স্যার আসার পর তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি আমাকে উৎসাহ দেন। তার পরামর্শেই আমি অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছি। কৃষি অফিস থেকে কিছু সার আর মেশিন সহোযোগিতা পেয়েছি এবং আরোও কিছু দিবো বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়া এই বাগানে বরই এর সাথে মিষ্টি কুমড়া, পেঁপেঁ, পেয়ারা, মাল্টা ও কাটিমন আমও চাষবাদ করছি।

গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি অফিসার তানভীর আহমেদ সরকার বলেন, আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলায় শুধু আম চাষই হয় না, এই উপজেলায় আম চাষের পাশাপাশি মাল্টা, কমলা, বরইসহ অনান্য ফলবাগনোও চাষ হয়ে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় গোমস্তাপুর উপজেলা ফুল, ফল ও ফসলে একটি বৈচিত্রময় উপজেলা। গোমস্তাপুর উপজেলায় এইবছর ১৬৫ হেক্টর জমিতে বরই চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬০ হেক্টর জমিতে। আমরা চেষ্টা করছি বিভিন্ন পরিকল্পনার আওতায় কৃষকে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে বরই চাষ যে একটি লাভজনক চাষ সেটি কৃষকে বুঝিয়ে এবং অনুপ্রাণিত করে  বরই চাষ আরোও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি।

তিনি আরোও বলেন, গোমস্তাপুর উপজেলায় প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে সামিউল হক নামে একজন উদ্যোক্তা বরই চাষ করছেন এবং সফল একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমরা সামিউল হকের বাগান পরিদর্শন করেছি। তাকে বিভিন্নভাবে কৃষিবিষয়ক পরামর্শ থেকে শুরু করে অনান্য বিষয়ে যতটুকু সহোযোগিতা আমাদের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রয়োজন ততটুকুই সহোযোগিতা আমরা করেছি। তিনি বরই চাষের পাশাপাশি আম ও পেয়ারাও চাষ করে থাকেন। তাকে কৃষি যন্ত্রপাতি দিয়েও সহোযোগিতা করেছি। যাতে তিনি আবাদটা সুন্দরভাবে করতে পারে এবং সার্বক্ষণিক আমরা তার সাথে যোগাযোগ রাখছি। যাতে কোন ধরনের সমস্যা হলে আমরা সহজে তাকে কৃষি বিষয়ক পরামর্শ দিয়ে তাকে সহোযোগিতা করতে পারি এবং তার লাভজনক কৃষির ধারাটা যেন বজায় রাখতে পারে ও ব্যানিজ্যিকভাবে যেন কৃষিটাকে এগিয়ে নিতে পারেন সেই প্রচেষ্টা আমরা চালাচ্ছি। এছাড়া পার্টনার প্রোগামের আওতায় তাকে ক্যাপের ট্রেনিং দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি এবং তার বরই বাগানটিকে ক্যাপের আওতায় নেওয়া যায় কি না সেই চিন্তাভাবনা থেকে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। অতিশীঘ্রই হইতো এই বরই বাগান থেকে বরই বিদেশে রপ্তানী করা হবে সেই পরিকল্পনাও আমরা গ্রহন করেছি।

এমএএ/আআ


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর