ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিপুল ভোটে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হয়েছেন রাঙামাটির প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা তরুণ এস এম ফরহাদ। ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি পান ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট, যা তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রাপ্ত ভোটের দ্বিগুণ।
ফরহাদের এই অর্জন কেবল একটি নির্বাচনী ফল নয়, এটি পাহাড়ি জনপদের স্বপ্ন, এক তরুণের দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি এবং গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জাতীয় অঙ্গনে জায়গা করে নেওয়ার অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে উঠেছে।
রাঙামাটির নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাহাড়-অরণ্য আর নীলাভ কাপ্তাই হ্রদের ছবি। এই মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির কোলেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফরহাদের। তার বাড়ি লংগদু উপজেলার মাইনী ইউনিয়নের গাথাছড়া গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের হাফেজ মাওলানা ফোরকান আহমেদের ছেলে। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের সরলতা, নদীর কলকল ধ্বনি আর পাহাড়ি পরিবেশ তাকে ছোটবেলা থেকেই শান্ত, অধ্যবসায়ী ও মেধাবী হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
দুই ভাইবোনের মধ্যে ফরহাদ বড়। স্থানীয় বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া আদর্শ দাখিল মাদরাসায় তিনি দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এর আগেই ৫ম ও ৮ম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় মেধার প্রমাণ দেন। পরে আলিম পড়ার জন্য ভর্তি হন চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ মাদরাসায়। যেখানে ধারাবাহিক সাফল্যে শিক্ষকদের আস্থা ও সহপাঠীদের ভালোবাসা অর্জন করেন। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে। পাহাড়ি জনপদ থেকে রাজধানীতে আসা তার জন্য সহজ ছিল না। তবে অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে তিনি দ্রুত মানিয়ে নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক ও বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি, জসীমউদ্দীন হল ডিবেটিং ক্লাব, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদ ও হিল সোসাইটিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি। বিতর্ক মঞ্চে তার সাবলীল উপস্থাপনা ও নেতৃত্বের গুণাবলী সহপাঠীদের কাছে তাকে প্রেরণার প্রতীক করে তোলে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ফরহাদ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। এর মধ্য দিয়েই তার নেতৃত্ব নতুন করে আলোচনায় আসে।
২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ফরহাদের প্রার্থিতা ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নির্বাচনে তিনি পান ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের প্রার্থী পান ৫ হাজার ২৮৩ ভোট। দ্বিগুণ ভোটে জয়ী হয়ে তিনি হয়েছেন ডাকসুর নতুন সাধারণ সম্পাদক। শুধু তাই নয়, তার প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ ১২টির মধ্যে ৯টি সম্পাদকীয় পদে জয় লাভ করেছে।
ফলাফল ঘোষণার পর ফরহাদ বলেন, এটি শুধু আমার বিজয় নয়, এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিজয়। তারা আমাকে যে আস্থায় ভোট দিয়েছেন, সেটি একটি আমানত। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব এই আস্থা রক্ষা করতে।
এদিকে ডাকসু নির্বাচনে ফরহাদের বিজয়ের খবর তার জন্মভূমি রাঙামাটিতে পৌঁছাতেই উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক-সহপাঠী সবাই আনন্দে আপ্লুত হন। গ্রামের মানুষের চোখে তখন গর্ব আর স্বপ্ন ভেসে ওঠে। তারা বলেন, আমাদের ছেলে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক— এটা আমাদের জন্য গর্বের।
এলাকাবাসী বলেন, ফরহাদ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন নম্র, ভদ্র ও মেধাবী। তার ডাকসু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার খবর পেয়ে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত।
বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া আদর্শ দাখিল মাদরাসার সহ-সুপার মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, সে (ফরহাদ) ছোট থেকেই অত্যন্ত মেধাবী। তার আচার, ব্যবহার, কথাবার্তা খুব সুন্দর ছিল। সব শিক্ষক-সহপাঠীর পছন্দের ছিলো সে। এরপর এখান থেকে সে চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ মাদরাসায় যায় আলিম করার জন্য, সেখানেও সব শিক্ষকদের পছন্দের হয়ে উঠে সে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, বর্তমানে সেখানে ডাকসুর সাধরেণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের। আমাদের একজন ছাত্র এত বড় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিএস হয়েছে আমরা সবাই অনেক খুশি।
বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া আদর্শ দাখিল মাদরাসার সুপার ও ফরহাদের বাবা হাফেজ মাওলানা ফোরকান আহমেদ বলেন, পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের দ্বারা যেকোনো খেদমত নিতে চাইলে আল্লাহ তায়ালা সেইভাবে সেই ব্যক্তিকে, সেই বান্দাকে গড়ে তোলেন। আমার ছেলে ফরহাদ আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে জিএস প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হওয়া বা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সফলতা অর্জন করা, তাতে আমার কোনো ব্যক্তিগত অবদান নেই বললেই চলে। এটা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার দয়া আর মেহেরবানি। আমি মনে করি, ফরহাদের এই বিজয় শুধু তার একার নয়—এটা মূলত ছাত্রদের বিজয়। তারা শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য হয়তো ফরহাদকে যোগ্য মনে করেছে। তাদের এই বিশ্বাস যেন আমার ছেলে সঠিকভাবে অটুট রাখতে পারে, সেই দোয়া আমি আল্লাহর কাছে করি। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ, যারা আমার ছেলের পথচলায় সহযোগিতা করেছেন এবং তাকে আজকের অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আমার দুই সন্তান— বড় ছেলে ফরহাদ এবং তার ছোট বোন। ছোটবেলা থেকেই ফরহাদ মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের ছিল। কোনো খারাপ কাজে সে জড়াতো না। পড়াশোনায় সব সময় ভালো করত, এমনকি প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সে বৃত্তি পেয়েছিল। যদিও দাখিল পরীক্ষায় বিশেষ কারণে প্রত্যাশিত ফল করতে পারেনি, তবুও ফার্স্ট ক্লাসের কাছাকাছি ফলাফল অর্জন করে। বর্তমানে আমি শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত আছি এবং ফরহাদ যে মাদরাসায় পড়াশোনা করেছে, সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
ডেস্ক/ই.ই
মন্তব্য করুন: