[email protected] ঢাকা | মঙ্গলবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১লা আশ্বিন ১৪৩১
thecitybank.com

ভাষা শহীদের সংখ্যা কত?


প্রকাশিত:
১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২, ১৫:৩৫

ছবি সংগৃহীত
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় কয়েকজন তরুণের বুকের রক্ত ঝরেছিল। প্রতিবছর ওই দিনটি আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকি। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ ভোরবেলা হাতে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে যায় শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতে। রাত ১২টা বাজার সাথে সাথে আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধান শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি দেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, বায়ান্নর শহীদদের আলাদা ভাবে "ভাষা শহীদ" নামে ডাকা হচ্ছে। অর্থাৎ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন। একাত্তর সালে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। স্বাধীনতার বীজ কিন্তু বোনা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। সুতরাং বলা যায়, ভাষা শহীদেরাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ। মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শুরু হয়ে ১৬ ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেল। বর্তমানে এটি একটি সরল গল্পে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের যে দীর্ঘ বিস্তৃত পটভূমি, ভাষা শহীদদের উপেক্ষা করে বা হিসাবে না রেখে এ দেশের ইতিহাস হবে খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ। কারণ, বায়ান্নর ভাষা শহীদেরাই আত্মবিসর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদের পথচলার শুরুটা করে দিয়েছিলেন এবং নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে একটা সর্বাত্মক জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা আলাদা রাষ্ট্র পেয়েছি। আমরা পাঁচজন শহীদের নাম বেশি বেশি শুনতে পাই: সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর। এঁদের মধ্যে বরকত ও জব্বার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রফিক ছিলেন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে। এঁরা তিনজন নিহত হন ২১ তারিখে। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা যান রিকশাচালক সালাম এবং হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অলি আহাদের ভাষ্যে জানা যায়, ২২ ফেব্রুয়ারি ভিক্টোরিয়া পার্কের (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক) আশপাশে, নবাবপুর রোড ও বংশাল রোডে গুলিতে কতজন মারা গেছেন, তার সঠিক সংখ্যা কারও জানা নেই। আহমদ রফিক তাঁর একুশ থেকে একাত্তর বইয়ে নিহতদের মধ্যে আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিনের নাম উল্লেখ করেছেন। ১৯৫৩ সালের মার্চে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে প্রথম স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন প্রকাশক এবং হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন সম্পাদক। ওই বইয়ে কবির উদ্দিন আহমেদ ‘একুশের ঘটনাপুঞ্জী’ নামে একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘শহীদদের লাশগুলো চক্রান্ত করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মেডিকেল হোস্টেলের ভেতর “গায়েবি জানাজা” পড়া হলো।...(পরদিন) সকাল নয়টায় জনসাধারণের এক বিরাট অংশ মর্নিং নিউজ অফিস জ্বালিয়ে দেয় এবং সংবাদ অফিসের দিকে যেতে থাকে। সংবাদ অফিসের সম্মুখে মিছিলের ওপর মিলিটারি বেপরোয়া গুলি চালায়। অনেকেই হতাহত হয় এখানে।’ প্রশ্ন হলো ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি মোট কতজন ‘হতাহত’ হয়েছিলেন, কতজন ‘নিহত’ হয়েছিলেন? তার সঠিক সংখ্যাটি কি আমরা জানি? কখনো জানার চেষ্টা করেছি? কবির উদ্দিন আহমেদের বিবরণ অনুযায়ী, ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘সর্বদলীয় কর্মপরিষদের’ পক্ষ থেকে ‘সর্বমোট ৩৯ জন শহীদ হয়েছেন বলে দাবি করা হয়’ এবং একই সঙ্গে সরকারের কাছে একটি ‘নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন নিয়োগের’ আহ্বান জানানো হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ হয়েছিল ব্যাপক। ওই দিন সন্ধ্যায় গণতান্ত্রিক যুবলীগের চট্টগ্রাম জেলা শাখার আহ্বায়ক এবং সীমান্ত পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী রোগশয্যায় বসে ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখেন। কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল: ওরা চল্লিশজন কিংবা আরও বেশি যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রোদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়... চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত... এখানে কবি যে ৪০ সংখ্যাটি উল্লেখ করলেন, তা কি নিছক ছন্দ মেলানোর জন্য, নাকি এর মধ্যে সত্যতা আছে? আমরা এ যাবৎ আটজন শহীদের নাম পেয়েছি। সংখ্যাটি কি এখানেই শেষ? বায়ান্নর ২১-২২ ফেব্রুয়ারি তারিখে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁরা আমাদের জাতীয় বীর। তাঁদের রক্তের পথ বেয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। অথচ তাঁরা সংখ্যায় কতজন, কী তাঁদের নাম, কোথায় তাঁদের বাড়ি, কী ছিল তাঁদের পেশা? আমরা কিছুই জানি না। আমরা ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি করি, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির নালিশ জানাই। শহীদেরা কি সব সময় রাজনীতির কাঁচামাল এবং ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবেই ব্যবহৃত হবেন? বছরে একদিন তাঁদের স্মরণ করে একটি বিবৃতি দিলেই কি আমরা এর ঋণ শোধ করতে পারবো? এ দেশে সর্বজনীন ‘শহীদ’ কয়জন? ভাষাশহীদেরা তো সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তাঁরা তো আমাদের সবার। তাই, উচ্চ মহলের কাছে বিশেষ প্রার্থনা, ভাষা শহীদদের তালিকা প্রস্তুত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করুন। এটি করতে না পারলে আমরা আমরা জাতি হিসেবে অকৃতজ্ঞ থেকে যাবো। লেখকঃ নাফিউল হক নাফিউ, (কবি ও প্রাবন্ধিক),সাহিত্য সম্পাদক,মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম ছাত্র সংসদ,কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল। নাফিউ/আশিক

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর