প্রকাশিত:
৭ নভেম্বার ২০২৫, ১৭:৫৪
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের কালুপুর এলাকার কৃষক আব্দুস সাত্তার এবার দোকান থেকে বাকিতে সার, বীজসহ বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে আমন ধানের আবাদ করেছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি ধান মাড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মাড়াই শেষে ধান বিক্রি করে দোকানের বাকির টাকা পরিশোধ এবং মহাজনের ফুরতের ধান (জমির লিজ বাবদ টাকার পরিবর্তে বিঘা প্রতি ১০ মণ ধান) দেওয়ার পরিকল্পনাও ছিল তার। কিন্তু হঠাৎ করে অসময়ের ভারী বৃষ্টিতে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এখন সার-বিষের দেনা ও মহাজনের ফুরাত নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তিনি। শুধু সাত্তারই নন, তার মতো আরও অনেক কৃষক একই সংকটে দিন কাটাচ্ছেন।
সরজমিনে দেখা গেছে, বৃষ্টিতে মাঠের ধান নুইয়ে পড়েছে। যদিও কোথাও কোথাও পানি নেমে গেছে, তবুও ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবার ভেজা পরিবেশে ধানে পোকা দেখা দিচ্ছে, ফলে নতুন করে কীটনাশক স্প্রে করতে হচ্ছে। এতে খরচ বাড়ছে। অন্যদিকে হাঁটু পানিতে ধান কাটতে হচ্ছে বলে শ্রমিকরাও বাড়তি মজুরি দাবি করছেন।
কৃষকরা জানাচ্ছেন, তারা প্রতি বিঘায় ৩০ থেকে ৩৫ মণ ধানের ফলন আশা করেছিলেন। কিন্তু বৃষ্টির পর এখন বিঘায় ১৮ থেকে ২২ মণ ধান পাওয়ার সম্ভাবনা। এর মধ্যে মহাজনের জমি চাষ করায় বিঘা প্রতি ১০ মণ ধান ফুরাত হিসেবে দিতে হবে। ফলে আমনের ধান ঘরে তোলার আনন্দের সময় এখন দুশ্চিন্তায় ভরে গেছে তাদের জীবন।
তবে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, মাঠ পর্যায়ে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের উপযুক্ত প্রণোদনাও দেওয়া হবে।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত জেলায় গড়ে ১৯১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং নজিরবিহীন। সাধারণত মধ্য কার্তিক মাসে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। এ বৃষ্টিতে জেলার ৪ হাজার ৪৫৯ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন ধান।
কৃষক আব্দুস সাত্তার বলেন, আমি প্রায় সাড়ে ১২ বিঘা জমিতে ধান করেছি। এর মধ্যে বৃষ্টিতে ৮ বিঘা ধান নুইয়ে গেছে। সার-বিষ বাবদ দোকানে প্রায় ২৫ হাজার টাকা বাকি আছে। এখন ধান নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। শ্রমিকরা এসে জমির অবস্থা দেখে হতবাক। বিলে ধান ভাসছে, কাঁদার কারণে গাড়িও ঢুকছে না। উপরন্তু তারা মজুরি বেশি চাইছে। যেভাবেই হোক দেনা শোধ করতেই হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কৃষি কার্ড আছে, কিন্তু তবুও কোনো সহায়তা পাই না। আমরাও তাই সরকারের ওপর ভরসা রাখতে পারি না।
কৃষক মনিরুল ইসলাম বলেন, আমি ৫ বিঘা পরের জমিতে ধান চাষ করেছি, তাও ঋণ করে। বৃষ্টির কারণে অনেক ক্ষতি হয়েছে। ধান পড়ে গিয়ে ফলন কমে গেছে। আগে প্রতি বিঘায় ৩০-৩৫ মণ ধান আশা করছিলাম, এখন ভালো হলে ২০-২৫ মণ পাবো। ধার-দেনা করে ডিলারের কাছ থেকে সার, বীজ, বিষ নিয়েছিলাম। ধান বিক্রি করে শোধ করার কথা ছিল। এখন যদি বিঘায় ১০ মণ করে কম হয়, তাহলে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। সরকার যদি অনুদান দেয়, তাহলে হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারবো।
আরেক কৃষক আনাসারুল হক বলেন, আমি ৬ বিঘা জমিতে ধান করেছিলাম ৫ বিঘা মোটা ধান, ১ বিঘা আতব ধান। বৃষ্টির আগে অবস্থা খুব ভালো ছিল, কিন্তু বৃষ্টির পর সব ধান পড়ে গেছে। এখন পোকা নিধনে বিঘা প্রতি প্রায় ১২০০ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। তারপরও আগের চেয়ে অর্ধেক ফলন পাবো। শ্রমিকরাও ধান কাটতে রাজি হচ্ছে না; যারা কাটছে তারা বেশি মজুরি চাইছে। আগে যেখানে ২৩ মণ ধান কাটলে ৩ মণ দিতে হতো, এখন ৫-৬ মণ চাচ্ছে। মজুরি ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০০-৭০০ টাকা হয়েছে। কোনো উপায় নেই, তাদের শর্ত মেনেই কাজ করাতে হচ্ছে। তাই সরকার যদি সহায়তা দেয়, তাহলে আমাদের অনেক উপকার হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ইয়াছিন আলী বলেন, অসময়ের বৃষ্টিতে জেলায় ধান, সবজি ও ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে আমন ধান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করেছি এবং মাঠ পর্যায়ে পুনরায় যাচাই করছি। কিছু জমির ফসল সম্পূর্ণ, আবার কিছু আংশিক নষ্ট হয়েছে। যেসব ধানের দানা শক্ত হয়ে গেছে সেগুলোতে স্প্রে করার দরকার নেই, বাকিগুলোতে স্প্রে করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রবি মৌসুমে ভালো ফলনের জন্য কৃষকদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে।
এম.এ.এ/আ.আ
মন্তব্য করুন: